Tuesday, November 19, 2013

‘কবি দিলওয়ার’


-বজলুর রশীদ চৌধূরী

শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি গণকবি দিলওয়ার,
মৃত্যু কোলে হাসছ তুমি, চোখে জল সবার।
তুমি সুখ তুমি শান্তি তুমি ছিলে আশা,
তুমি কাব্যের সফল নায়ক, সকল ভালবাসা।
ক্ষণজন্মা পুরুষ তুমি, সফল তোমার কর্ম,
একুশে পদক বুঝিয়ে দিল কবি বাউলের মর্ম।
তোমার স্বপন তোমার জীবন তব চিন্তাধারা,
পূরণ করে যাবো মোরা, পাছে আছি যারা।
টেলিফোনের শেষ উপদেশ মনে থাকবে মোর,
বজলু তুমি সাজিয়ে তোল গ্রাম-বাংলার ঘর।
তোমার মাঝে যা পেয়েছি লিখার ভাষা নাই,
তোমায় নিয়ে সিলেট-বাংলা গর্ব করে বেড়াই।
যুগে যুগে কত মানুষ, আসে আর যায়,
তারই মাঝে মাত্র ক’জন অমর এই ধরায়।
কবি তুমি চলে গেছ, থাকবে চিরকাল,
তোমায় মোরা করবো স্মরণ, সালের পর সাল।
ঠান্ডাজ্বরে ভোগছি আমি হাসপাতালে শুয়ে,
শ্রদ্ধাভরে করছি স্মরণ তোমার কাব্য ছুঁয়ে।
কবির কথা স্মরণ করে ডাকি দয়াময়,
দিলওয়ার ভাই’র তরে যেন বেহেস্ত নসীব হয়।

Wednesday, October 2, 2013

এক মায়ের সন্তান

বজলুর রশীদ চৌধূরী


এক মায়ের সন্তান মোরা, বীর সাহসী জাতি,
সুখে-দুঃখে থাকি সবাই একে অন্যের সাথী।
এক ভাষায় কথা বলি, একই দেশে বাস,
এক মাঠেতে খেলে-ধূলে পূর্ন করি আশ।
এক স্কুলের ছাত্র মোরা, একই সবক পড়ি,
আউল-বাউল  গানের সুরে হৃদয় মন ভরি।
হিন্দু-মুসলিম ভাই ভাই, করি গলাগলি,
ঝগড়া-বিবাদ নাইকো মোদের এক সাথে চলি।
জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে স্ব স্ব পোশাক পরি,
ভাতে-মাছে এই বাঙ্গালী, কত গৌরব করি।
বিশ্ব জুড়ে সুনাম আছে মোরা বীরের জাতি,
যুদ্ধ করে মুক্ত হয়ে জ্বালাই স্বাধীন বাতি।
ভাষাযুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধে অনেক গেল চলি,
শহীদ-গাজীর বাংলা আমার গর্ব করে বলি।
এক হাটে সওদা করি, এক কাষ্ঠে রাঁধা,
মিলেমিশে থাকি মোরা জাতি সূতায় বাঁধা।
গৌরব ভরা জাতি মোরা, বুকে আছে বল,
এমন সুন্দর দেশ আমার কেন হবে অচল ?
দিনের পথে দিন যাক্ , আবার আসবে ফিরে,
সত্য যত কঠিন হোক, থাকবো তাকে ঘিরে।
এক মাঘে যায়না শীত, এক গ্রীষ্মে গরম,
কঠিন সত্য মেনে নিয়ে মনকে করি নরম।
এক মনে এক ধ্যানে থাকি সারা জনম,
দেশ-জাতির ক্ষতি হলে নিজে হবো খতম।
দেশের কথা জাতির ব্যথা সদা থাকুক মাথায়,
আপন ভুলে যাইনা যেন অতীত খাতার পাতায়।
মায়া ভরা দৃষ্টি থাকুক, আদর ভরা উদর,
সারা জনম পরবো মোরা মহাসুখের চাঁদর।
আসুন সবাই এক সারিতে হাত তুলে বলি,
হানাহানির বদলা নেই করে গলাগলি।
ভালবাসা কথাটাকে আসুন ভালবাসি,
জাতির ঐক্য গড়ে তুলে, হাসি তৃপ্তির হাসি।
দেশ গড়ার শপথ নিয়ে গাহি ঐক্যের গান,
অতীত ব্যথা ভুলে ফেলে উড়াই বিজয় নিশান।

লেখক ঃ মিশিগান, যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী

Wednesday, September 18, 2013

ষড়ঋতু

বজলুর রশীদ চৌধূরী
ষড়ঋতুর দেশ আমাদের কত সুন্দর লাগে,
এক ঋতু শেষ হতে আরেক ঋতু জাগে।
দুই মাসে এক ঋতু বার মাসে ছয়,
এক সমান দুই ঋতু কোন কালে নয়।
মাসে মাসে বদলায় দিন বিধির বিধান বলে,
ফল ফুল খরা বৃষ্টি প্রমান তার মিলে।
ফাল্গুন চৈত্র ফুলে ফুলে, বৈশাখ জৈষ্ঠ্য ফল,
আষাঢ় শাওন বর্ষাকাল, জলের উপর জল।
কার্তিক আগন সোনার ফসল, মাঠে পাঁকা ধান,
খুশীর শানাই বাজায় কৃষক, কন্ঠে ভরা গান।
ভাদ্র-আশ্বিন শীতের বার্তা, গাছে পাকা তাল,
পাড়ায় পাড়ায় পিঠার ধুম আছে সর্বকাল।
হাড় কাঁপানো পৌষ-মাঘে, ভেজা কাঁথার ফাঁক,
আঁধার রাতে ভেসে আসে নিশি পেঁচার ডাক।
শীতকালে শুকিয়ে যায় খাল বিল সারা,
হাওরী পথের বাউরী বাতাস জুড়ায় প্রানের ধারা।

লেখক ঃ মিশিগান, যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী

Wednesday, September 11, 2013

‘শ্যামল বাংলা’


‘শ্যামল বাংলা’
বজলুর রশীদ চৌধুরী

শ্যামল সুন্দর বাংলা আমার, সবুজের নাই শেষ
এই তো আমার জন্মভূমি, রূপের বাংলাদেশ।
যত দেখি তারে আমি, আরো দেখতে চাই,
প্রকৃতির রূপের বাহার আমার দেশে পাই।
ফুল ফুটে বার মাস, ফল সারা বছর,
ফলে ফুলে ভরা বাংলা, আছে তার কদর।
আকাশ ঘেঁষা সবুজ পাহাড়, উঁকী দিয়ে চায়,
দেখে যেন মনে হয় নীল আকাশের গায়।
চারিদিকে বনলতা, সবুজ শাড়ী পরে,
সারি সারি ফুলের ঘ্রাণ, তনুমন ভরে।
হাওর বিলে মাছের খেলা, ক্ষেতের মাঠে ফসল,
ঝোঁপ-জঙ্গঁলে ঘুরে বেড়ায়, নিশাচরের দল।
সাগর কোনের বায়ূ টানে, নেমে আসে ঢল,
নদী নালা বয়ে চলে , বৃষ্টি ঝরা জল।
নদীর তীরে গ্রাম-গঞ্জ, সারি সারি ঘর,
একুল ভাঙ্গে ওকুল গড়ে, জাগে নূতন চর।
গো-ধূলিতে বাংলা রানী হলুদ শাড়ী পরে,
সেজে যেন নববধু, যায় বাসর ঘরে।
মাঠের উপর সবুজ ঘাস, কুয়াশার চাঁদর পরে,
এত সুন্দর দেশ আমার, দেখি নয়ন ভরে।
সাগর জলে ভেসে বেড়ায়, হাজার হাজার জেলে,
জীবন তাদের কেটে যায়, মাছের সাথে খেলে।
কত বিশাল সাগর সৈকত, বিশ্ব সেরা বলে,
গায়ের তাপ শীতল করি, সাগর কন্যার জলে।
আরো কত দ্বীপ আছে, চোখে নিশা ধরে,
এক পলকে চেয়ে থাকি, হৃদয় উজার করে।
গাছ গাছালীর সবুজ মেলা, দেখতে লাগে বেশ,
এই তো আমার রূপের রানী, শ্যামল বাংলাদেশ।

মিশিগান, যুক্তরাষ্ট্র।

Thursday, September 5, 2013

‘বারুণী’


বজলুর রশীদ চৌধুরী
সারা বছর চেয়ে থাকি, চৈত্র মাসের আসে,
ছেলেবেলার এই চিন্তা, থাকে পাশে পাশে।
এই মাসের বার তারিখ, ‘হরইর বার্ণী’ হয়,
খুশীর তুফান বইতে থাকে, সকল পাড়াময়।
মায়ের কাছে কেঁদে বলি, অতি মিনত সুরে,
আট আনার পয়সা দাও মা, আসি    ‘বার্নী’ ঘুরে।
গাঁয়ের সব ছেলে-মেয়ে যা”েছ ‘হরইর’ মেলা,
হাওয়ার মিঠাই-খৈ কিনবে, দেখবে কত খেলা।
মঙ্গলবারে ‘কেউন বার্ণী’ বিরাট ষাড়ের লড়াই,
নিজ গাঁয়ে বড় ষাড়, করি কত বড়াই।
বিষুদ বারে ‘কাউয়ার বার্ণী’ আহা মরি মরি,
কত রঙ্গের দোকান বসে, সারা মাঠ ভরি।
সুন্দর সুন্দর পুতুল থাকে, আছে সুরের বাঁশি,
ফুক দিয়ে দৌড়ে দৌড়ে, সুরের মাঝে ভাসি।
কত দূরের মানুষ আসে, ‘কাউয়ার বার্ণী’র ডাকে,
আমড়াতৈলের ছেলে-বুড়ো অবশ্যই থাকে।
দুপুর থেকে জমে উঠে ‘কাউয়ার বার্ণী’র মাঠ,
চামারদিঘী পাশে আছে, জল খরচের ঘাট।
বিকালেতে লাঠি খেলা, ষাড়ের লড়াই আছে,
রাতের বেলা গাজীর গীত, নাচি খুশীর নাচে।
পূর্বদিকে জোয়ার আসর, ঝান্ডিমুন্ডা ডাকে,
কেহ কেহ কড়ার মাঝে, কেউ বা চরকির ফাঁকে।
তিন তাসী খেলার পার্টি, আছে কত কত,
পাশ তাস ছবি তাস, দেখায় অবিরত।
ইটখলার বার্ণী আছে, সামনের রবিবার,
এই মেলা জমে উঠে, যুগনী খালের পার।

মিশিগান, যুক্তরাষ্ট্র

Tuesday, August 27, 2013

`আমার গ্রাম’

বজলুর রশীদ চৌধুরী
স্মৃতি ভাসা গ্রাম আমার, সকল গাঁয়ের সেরা,
গাছে গাছে সবুজ মেলা, লতায় পাতায় ঘেরা।
ফলে ফুলে ভরা গ্রাম, রূপের কমতি নাই,
এঁটো পথের মেঠো বাতাস, হর-হামেশা পাই।
ফসল ভরা ক্ষেত আছে, আছে সবুজ মাঠ,
পাঠশালাতে গিয়ে শিখি, বাল্য শিক্ষার পাঠ,
পূর্ব-পশ্চিম দুইটি মসজিদ, ঝলমলিয়ে হাসে,
অতি সুন্দর গ্রাম আমার, রত্না নদীর পাশে।
বড় বড় তিনটি দিঘী, কালের সাক্ষী বয়,
ফাল্গুন-চৈত্রে অলি-আওলিয়ার, বার্ষিক ওরস হয়।
ইমামদিঘী কুমারদিঘী চামারদিঘীর কথা,
দিনে দিনে হচ্ছে বিলীন, দেখলে লাগে ব্যথা।
কূল ঘেঁষে যায় কত নাও ভাটির গান গেয়ে,
এক পলকে থাকি আমি তাদের দিকে চেয়ে।

আম বাগানের তলায় গিয়ে কত খেলা করি
সাথী আরো কত থাকে, বাগানতলা ভরি।
বাঁশ বাগানের ঝোঁপের ভিতর কত পাখী থাকে,
ভোরের আলো ফুটে উঠে, কিচির মিচির ডাকে।
মাঠে যায় ক্ষেতের চাষী, কাক ডাকার আগে,
ঘুমিয়ে পড়া গ্রাম আমার, ধীরে ধীরে জাগে।
চাকুরীজীবী অনেক মানুষ, শিক্ষার আছে মান,
মিলে মিশে চলি সবাই, নাহি কোন শান।
পরবাসে চলে গেছে, অনেক মানুষ হায়,
এত মায়ার গ্রাম আমার, কার বা পানে চায়?
ফেলে আসা দিনের কথা, ভাবী অবিরাম,
প্রবাস থেকে কাঁদে মন, হায়রে আমার গ্রাম।

মিশিগান, যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী

Wednesday, August 21, 2013

‘জামাইকাটা হাওর’

বজলুর রশীদ চৌধূরী

জামাইকাটা হাওরের নাম জানে সর্বলোকে,
মাছের রাজা ‘হুগলী বিল’ এই হাওরের বুকে।
রউ-বোয়াল-শউল-গজার বাইম আর গুজা,
শিং-মাগুর-পুটি-টেংরা-ভেড়া-কই মজা।
খাগবন-বুরবুরি-চিতলী-হচরা মিলে,
এই গুলি আজও আছে জামাইকাটার বিলে।
আতরা উড়উয়া দুইটি ‘ডুবী’ হাছলের উত্তর,
‘গাংগীনা-বড়বিল’ আটঘরের পর,
ফালগুন-চৈত্রে দুপুর বেলা সড়কের খালে,
ডুবে ডুবে মাছ ধরতাম ডুবের তালে তালে।
‘রাজা খাঁ-ফুলডুবী-ঘি উড়া’ মিলে,
‘লাংগল চুরা’য় ঘনিয়া ধরতাম কিসমতে দিলে।
মাঝেরচরা পূবেরচরায় কোমর পানি থাকে,
নাও ঠেলে ভেড়া ধরতাম বিলের বাঁকে বাঁকে।
‘হাবিজখালীর অচু টানা’ ইছা মারার ধুম,
এসব কথা মনে হলে ছেড়ে যায় ঘুম।
গাত টেনে পুটি ধরতাম হৈ হৈ রবে,
এক সাথে দশ-বারজন সুর করিতাম সবে।
মুলায়েমডুবী-দুমূখা-আঠালুর খাল,
চৈত্র মাসে ‘পল বাওয়া’ সঙ্গে থাকে জাল।
কইরপল-তরিকুচা-অচু আর শেওত,
খাইনজা সেচে মাছ ধরতাম আল্লাহর নিয়ামত।
খাইনজা সেচা টেপি ধরা ফালগুন চৈত্র মাসে,
চারিদিকে সবুজ ধান কৃষাণ ভাই হাসে।
টেংরার ঘা যেমন তেমন শিংগীর ঘা সার,
কোকড়ার জড় বাঁধিয়া দিলেও বিষ নামে না তার।
ভাদ্র, আশ্বিন ‘নাইয়া অচু’ সারা বিকাল চলে,
চাটা-বইছা-হাগাটালু-নাপিত বাদার তলে।
জৈষ্ঠ্য মাসে ঠেলা জালে ‘কই পুতরা’ ধরে,
‘চংগর পনা’ কত ধরলাম পনার খলই ভরে।
গাংগের ঘোলায় লোয়ারগাঁওর ঢালায় ভীড় ধরে মাছে,
ঘরে ঘরে খুঁজে দেখতাম কার পল আছে?
বিন্নাটেকী মাঝর গোপাট নয়া বাড়ীর তলে,
বিলের দিকে চেয়ে থাকতাম নৌকা পাব বলে।
কিশোর কালের অবুঝ মন পল নিয়ে হাতে,
এক দৌড়ে বিলে পৌঁছতাম গায়ের মানুষ সাথে।
এলেংগারকান্দি পাতলাচুরা-গউয়াবিলের কাড়া,
সব মিলিয়ে উত্তর দিক গউয়ার পার সারা।
জামাইকাটার উত্তর দিক বিল গউয়ার পার,
এই জমিনে পড়ে আছে বাল্য জীবন আমার।
হরে খাওরা-বাজারকান্দি-নাপ্তর টেকার জমি,
বড়বন্দের ঘাসের মাঝে ধান ছিল না কমি।
ছাটিরলামা -হাদারদাগ -আঠালুরমুখ,
কত মাছের উজাই দেখলাম ভাবতে লাগে দুখ।
আতনাকান্দির হিজল গাছ কতই মনে পড়ে,
কত রংগের দিন কাটাইলাম গাছের ডাল চড়ে।
‘গুটির গরু’ নিয়ে মোরা বসতাম গাছের তলে,
পানির পিয়াস মিঠাইতাম আঠালুখালের জলে।
আতনাকান্দির গরু চরে কত গরু চরে,
রাখাল ছেলের মিষ্টি গানে মন থাকত ভরে।
দুপুর পরে গরু যায় বানাইয়ার পতিত,
বাজারকান্দির কিরা -বাংগি চুরি করতাম নীত।
বানাইয়ার দুর্বা ঘাসে কত গড়াগড়ি,
মাঝে মধ্যে ঘুমিয়ে পড়তাম বাঁশের ছাতা ধরি।
শত শত শনির লেটা মাথার উপর থাকে,
লুকুচুরি কত খেলতাম কোকড়া বনের ফাঁকে।
চাতলার পার আত্মাকান্দি বানাইয়ার পতিত,
আজও ইহা পড়ে আছে শুধু আমি অতীত।
বিকালেতে ‘বিন্নাটেকী’ মানুষ-গরুর মেলা,
ফুটবল আর তাস খেলাতে চলে সারা বেলা।
কিশোর কালের এসব কথা কত স্মৃতি জাগে,
বয়স কালে এইগুলি সব স্বপ্ন জগত লাগে।
কত সুন্দর হাওর আমার কত বড় আকার,
পুর্ব থেকে চেয়ে দেখলে পশ্চিম নিরাকার।
পূর্ব দিকে লহরী আর চরচন্ডীর পার,
পশ্চিমে লোহারগাঁও -রসুলগঞ্জ বাজার।
দক্ষিণে হাছল-আমড়াতৈল-নাছিরপুর মৌজা,
এই স্থানে রত্না নদী পূর্ব পশ্চিম সোজা।
উত্তরে জাহিদপুর আর তালুপাট ধরে,
এই জায়গায় ডাউকী নদী সারা গেছে মরে।
মাছুখালী চরচন্ডী আর কয়বরখালীর ডর,
উত্তরেতে চাউলধনী এই গুলার পর।
জামাইকাটা কত সুন্দর কত রূপের বাহার,
বর্ষাকালে ফুটে উঠে, পূর্নযৌবন তার।
কদম্বের ফুল ডাকি বর্ষারে কয়,
অপেক্ষায় ফুটে আছি, আসিবে নিশ্চয়।
বর্ষাকালে জামাইকাটায় পানি থৈ থৈ করে,
পাল উড়াইয়া কত নৌকা রসুলগঞ্জ ধরে।
সারি সারি পালের নৌকা জামাইকাটার বুকে,
শত শত ডিংগী -বারকী খালের মুখে মুখে।
জলের উপর ভাসছে গ্রাম ডুবু ডুবু ঘর,
শাপলা-শেওলার লুকুচুরি মন ভরে দেয় মোর।
জলে ভাসা পদ্মফুল জলে খেলা করে,
ও পারের ঢেউ আসি এ পারেতে পড়ে।
যুগনী খালের পশ্চিম পার নজীপুরের উত্তর,
চিনে রাখ এই জায়গা কদমতলীর চর।
সাদুল্লারটেক-বিন্নারটেক-আধুয়াচকের দাগ,
পাটুমোহা মৌজাসহ একলা বুড়ার ভাগ।
দেওয়ানখালী- কউব্লাটেকার পশ্চিম পাশ দিয়া,
উত্তরপারে যাইতাম আম্রা গুটির গরু নিয়া।
দেওয়ানখালীর পাড়াগাতি-গোবরাগাতি বড় ভয়ংকর,
অসাবধানে ‘পাও’ ঢুকিলে কষ্ট পাইতাম জবর।
পূবরলোম-হাদারদাগ রাতা টেপি শাইল,
মাঝখানে চলার রাস্তা নাম তার ‘বড়াইল’।
জামাইকাটায় আরো আছে ‘তেরাচাপড়ি বিল’,
খতমাপুর গেলে দেখবায় পানির ঝিলমিল।
সমসপুরের গরুর গোপাট আর নাও দাড়া দিয়া,
চান্দরখালে নৌকা যাইত দেখতাম চাইয়া চাইয়া।
চোরাইকান্দি-নোয়াগাঁও-ডিগ্রীকিত্তার পরে,
বেগুন-বাংগি বেশী ফলে গড়গড়ির চরে।
এতকথা বলবো কাকে, শুনার মানুষ নাই,
যাহা আছে দুই একজন, কদাচিৎ পাই।
মনযোগে শুন বলি পরবর্তি বংশ,
ভুলে গেলে পড়ে নিও ইতিহাসের অংশ।
পাঠকের কাছে আমার এই নিবেদন,
ভুল ত্রুটি কিছু হইলে করিবেন মার্জন।

লেখক : মিশিগান, যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী।

(কবিতাটি লেখকের নিজ এলাকা সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর উপজেলার আমড়াতৈল-এ তাঁর বাল্যকালের
স্মৃতিকে কেন্দ্র করে লেখা।)

‘আমার পাঠশালা’

বজলুর রশীদ চৌধুরী
বাল্যকালের অতীত দিনে ভেসে বেড়ায় মন,
পাড়ায় পাড়ায় দৌড়-ঝাঁপ, খেলতাম সারাক্ষণ।
মায়ে খেদানো বাপে তাড়ানো নিত্যদিনের বিষয়,
শাসন ভাষন যতই চলুক, খেলতে আমার হয়।
পাঁচের উপর বয়স আমার কবে হয়ে গেল,
বর্ণমালার একটি বর্ণ মুখে নাই এল।
এমন দিনে আদর করে মা বলেন ডেকে,
বড় বিদ্যান হবি খোকা, লেখাপড়া শিখে।
যাদু আমার মানিক আমার আয় সাথে আয়,
পাঠশালাতে যাবি তুই, ঐ যে দুরের গাঁয়।
হেঁটে হেঁটে যাবি বাপ, আমি থাকবো চেয়ে,
সঙ্গে আরো কত আছে, যাবে তোকে নিয়ে।
বড় চিন্তা ঢুকে গেল কচি মাথার ভিতর,
ইশ্কুল কেমন মাস্টার কেমন, কে জানাবে খবর।
পরদিন সকাল বেলা মাকে সাথে করে,
রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে থাকি, অজানা এক ডরে।
আঁকা বাঁকা রাস্তা এই, গেছে অনেক দূর,
ক্ষেতের ফসল কাটছে চাষী, কণ্ঠে তুলে সুর।
কত মানুষ আসে যায় এই পথ ধরে,
তাদের পিছে আমিও যাচ্ছি, পাঠশালার তরে।
এমন সময় রহিম উদ্দিন পিছন থেকে ডাকে,
আমরা যাচ্ছি পাঠশালাতে সঙ্গে নেব তোকে।
দূরের গাঁয়ে চেয়ে দেখি লাল টিনের ঘর,
ইহাই আমার পাঠশালা, বাল্য শিক্ষার বর।
প্রথম মানের ছাত্র আমি, সঙ্গে আরো কত,
স্বরে ‘অ’ স্বরে ‘আ’ পড়ি অবিরত।
ছুটি হলে খুশী মনে বাড়ী ফিরে আসি,
পথের পাশে মা দাঁড়িয়ে মুখে মিষ্টি হাসি।
তেঁতুল বিচি -ধুলো মাটি সঙ্গে নেওয়া চাই,
তা না হলে কঠিন শাস্তি, দিবেন গুরু মশাই।
বর্ণলিখে সংখ্যা শিখে, আঙ্গিনাতে চলি,
ছুটির পূর্বে শতকিয়া মুখে মুখে বলি।
ধূলির উপর যত লেখা বানান আসল খুঁটি,
শেষ বছরের পরীক্ষায় দ্বিতীয় মানে উঠি।
খাগার কলম হরিতকি বনলতার রস,
এসব দিয়ে কলাপাতায় লিখি খসখস।
যোগ-বিয়োগ-পূরণ-ভাগ পাঠশালার পড়া,
শুভংকরের ফাঁকি আছে, সঙ্গেঁ গন্ডা কড়া।
নামতা-অংক শিক্ষা,শ্র“তিলিপির পাঠ,
হরহামেশার সবক ইহা, যেন বিদ্যার মাঠ।
ছোট্ট কুঠির পাঠশালা মোর, বিদ্যাপিঠের গুরু
এইখানে মোর বাল্য কৈশোর, লেখা পড়ার শুরু।
গাঁয়ের আরো কত ছেলে, এক সাথে যাই,
সুযোগমত পিয়ারা লিচু চুরি করে খাই।
বরই গাছের পাতি ডালে কত বরই পাঁকা,
কচি মুখে লালা ঝরে, ধৈর্য যায় না রাখা।
কত সাথী ফেল করে, কত যায় ছেড়ে
পাঠশালাতে আসে না আর, পড়ার যুদ্ধে হেরে।
ফেলে আসা দিনগুলি বারে বারে উঠে,
রেখে যাওয়া স্মৃতি ভাসে, আমার মনের তটে।
সাথী আসে সাথী যায় বিরহের জ্বালা,
পাশ দিয়ে রেখে এলাম, আমা-র পাঠশালা।

মিশিগান, যুক্তরাষ্ট্র।