বজলুর রশীদ চৌধূরী
জামাইকাটা হাওরের নাম জানে সর্বলোকে,
মাছের রাজা ‘হুগলী বিল’ এই হাওরের বুকে।
রউ-বোয়াল-শউল-গজার বাইম আর গুজা,
শিং-মাগুর-পুটি-টেংরা-ভেড়া-কই মজা।
খাগবন-বুরবুরি-চিতলী-হচরা মিলে,
এই গুলি আজও আছে জামাইকাটার বিলে।
আতরা উড়উয়া দুইটি ‘ডুবী’ হাছলের উত্তর,
‘গাংগীনা-বড়বিল’ আটঘরের পর,
ফালগুন-চৈত্রে দুপুর বেলা সড়কের খালে,
ডুবে ডুবে মাছ ধরতাম ডুবের তালে তালে।
‘রাজা খাঁ-ফুলডুবী-ঘি উড়া’ মিলে,
‘লাংগল চুরা’য় ঘনিয়া ধরতাম কিসমতে দিলে।
মাঝেরচরা পূবেরচরায় কোমর পানি থাকে,
নাও ঠেলে ভেড়া ধরতাম বিলের বাঁকে বাঁকে।
‘হাবিজখালীর অচু টানা’ ইছা মারার ধুম,
এসব কথা মনে হলে ছেড়ে যায় ঘুম।
গাত টেনে পুটি ধরতাম হৈ হৈ রবে,
এক সাথে দশ-বারজন সুর করিতাম সবে।
মুলায়েমডুবী-দুমূখা-আঠালুর খাল,
চৈত্র মাসে ‘পল বাওয়া’ সঙ্গে থাকে জাল।
কইরপল-তরিকুচা-অচু আর শেওত,
খাইনজা সেচে মাছ ধরতাম আল্লাহর নিয়ামত।
খাইনজা সেচা টেপি ধরা ফালগুন চৈত্র মাসে,
চারিদিকে সবুজ ধান কৃষাণ ভাই হাসে।
টেংরার ঘা যেমন তেমন শিংগীর ঘা সার,
কোকড়ার জড় বাঁধিয়া দিলেও বিষ নামে না তার।
ভাদ্র, আশ্বিন ‘নাইয়া অচু’ সারা বিকাল চলে,
চাটা-বইছা-হাগাটালু-নাপিত বাদার তলে।
জৈষ্ঠ্য মাসে ঠেলা জালে ‘কই পুতরা’ ধরে,
‘চংগর পনা’ কত ধরলাম পনার খলই ভরে।
গাংগের ঘোলায় লোয়ারগাঁওর ঢালায় ভীড় ধরে মাছে,
ঘরে ঘরে খুঁজে দেখতাম কার পল আছে?
বিন্নাটেকী মাঝর গোপাট নয়া বাড়ীর তলে,
বিলের দিকে চেয়ে থাকতাম নৌকা পাব বলে।
কিশোর কালের অবুঝ মন পল নিয়ে হাতে,
এক দৌড়ে বিলে পৌঁছতাম গায়ের মানুষ সাথে।
এলেংগারকান্দি পাতলাচুরা-গউয়াবিলের কাড়া,
সব মিলিয়ে উত্তর দিক গউয়ার পার সারা।
জামাইকাটার উত্তর দিক বিল গউয়ার পার,
এই জমিনে পড়ে আছে বাল্য জীবন আমার।
হরে খাওরা-বাজারকান্দি-নাপ্তর টেকার জমি,
বড়বন্দের ঘাসের মাঝে ধান ছিল না কমি।
ছাটিরলামা -হাদারদাগ -আঠালুরমুখ,
কত মাছের উজাই দেখলাম ভাবতে লাগে দুখ।
আতনাকান্দির হিজল গাছ কতই মনে পড়ে,
কত রংগের দিন কাটাইলাম গাছের ডাল চড়ে।
‘গুটির গরু’ নিয়ে মোরা বসতাম গাছের তলে,
পানির পিয়াস মিঠাইতাম আঠালুখালের জলে।
আতনাকান্দির গরু চরে কত গরু চরে,
রাখাল ছেলের মিষ্টি গানে মন থাকত ভরে।
দুপুর পরে গরু যায় বানাইয়ার পতিত,
বাজারকান্দির কিরা -বাংগি চুরি করতাম নীত।
বানাইয়ার দুর্বা ঘাসে কত গড়াগড়ি,
মাঝে মধ্যে ঘুমিয়ে পড়তাম বাঁশের ছাতা ধরি।
শত শত শনির লেটা মাথার উপর থাকে,
লুকুচুরি কত খেলতাম কোকড়া বনের ফাঁকে।
চাতলার পার আত্মাকান্দি বানাইয়ার পতিত,
আজও ইহা পড়ে আছে শুধু আমি অতীত।
বিকালেতে ‘বিন্নাটেকী’ মানুষ-গরুর মেলা,
ফুটবল আর তাস খেলাতে চলে সারা বেলা।
কিশোর কালের এসব কথা কত স্মৃতি জাগে,
বয়স কালে এইগুলি সব স্বপ্ন জগত লাগে।
কত সুন্দর হাওর আমার কত বড় আকার,
পুর্ব থেকে চেয়ে দেখলে পশ্চিম নিরাকার।
পূর্ব দিকে লহরী আর চরচন্ডীর পার,
পশ্চিমে লোহারগাঁও -রসুলগঞ্জ বাজার।
দক্ষিণে হাছল-আমড়াতৈল-নাছিরপুর মৌজা,
এই স্থানে রত্না নদী পূর্ব পশ্চিম সোজা।
উত্তরে জাহিদপুর আর তালুপাট ধরে,
এই জায়গায় ডাউকী নদী সারা গেছে মরে।
মাছুখালী চরচন্ডী আর কয়বরখালীর ডর,
উত্তরেতে চাউলধনী এই গুলার পর।
জামাইকাটা কত সুন্দর কত রূপের বাহার,
বর্ষাকালে ফুটে উঠে, পূর্নযৌবন তার।
কদম্বের ফুল ডাকি বর্ষারে কয়,
অপেক্ষায় ফুটে আছি, আসিবে নিশ্চয়।
বর্ষাকালে জামাইকাটায় পানি থৈ থৈ করে,
পাল উড়াইয়া কত নৌকা রসুলগঞ্জ ধরে।
সারি সারি পালের নৌকা জামাইকাটার বুকে,
শত শত ডিংগী -বারকী খালের মুখে মুখে।
জলের উপর ভাসছে গ্রাম ডুবু ডুবু ঘর,
শাপলা-শেওলার লুকুচুরি মন ভরে দেয় মোর।
জলে ভাসা পদ্মফুল জলে খেলা করে,
ও পারের ঢেউ আসি এ পারেতে পড়ে।
যুগনী খালের পশ্চিম পার নজীপুরের উত্তর,
চিনে রাখ এই জায়গা কদমতলীর চর।
সাদুল্লারটেক-বিন্নারটেক-আধুয়াচকের দাগ,
পাটুমোহা মৌজাসহ একলা বুড়ার ভাগ।
দেওয়ানখালী- কউব্লাটেকার পশ্চিম পাশ দিয়া,
উত্তরপারে যাইতাম আম্রা গুটির গরু নিয়া।
দেওয়ানখালীর পাড়াগাতি-গোবরাগাতি বড় ভয়ংকর,
অসাবধানে ‘পাও’ ঢুকিলে কষ্ট পাইতাম জবর।
পূবরলোম-হাদারদাগ রাতা টেপি শাইল,
মাঝখানে চলার রাস্তা নাম তার ‘বড়াইল’।
জামাইকাটায় আরো আছে ‘তেরাচাপড়ি বিল’,
খতমাপুর গেলে দেখবায় পানির ঝিলমিল।
সমসপুরের গরুর গোপাট আর নাও দাড়া দিয়া,
চান্দরখালে নৌকা যাইত দেখতাম চাইয়া চাইয়া।
চোরাইকান্দি-নোয়াগাঁও-ডিগ্রীকিত্তার পরে,
বেগুন-বাংগি বেশী ফলে গড়গড়ির চরে।
এতকথা বলবো কাকে, শুনার মানুষ নাই,
যাহা আছে দুই একজন, কদাচিৎ পাই।
মনযোগে শুন বলি পরবর্তি বংশ,
ভুলে গেলে পড়ে নিও ইতিহাসের অংশ।
পাঠকের কাছে আমার এই নিবেদন,
ভুল ত্রুটি কিছু হইলে করিবেন মার্জন।
লেখক : মিশিগান, যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী।
(কবিতাটি লেখকের নিজ এলাকা সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর উপজেলার আমড়াতৈল-এ তাঁর বাল্যকালের
স্মৃতিকে কেন্দ্র করে লেখা।)
জামাইকাটা হাওরের নাম জানে সর্বলোকে,মাছের রাজা ‘হুগলী বিল’ এই হাওরের বুকে।
রউ-বোয়াল-শউল-গজার বাইম আর গুজা,
শিং-মাগুর-পুটি-টেংরা-ভেড়া-কই মজা।
খাগবন-বুরবুরি-চিতলী-হচরা মিলে,
এই গুলি আজও আছে জামাইকাটার বিলে।
আতরা উড়উয়া দুইটি ‘ডুবী’ হাছলের উত্তর,
‘গাংগীনা-বড়বিল’ আটঘরের পর,
ফালগুন-চৈত্রে দুপুর বেলা সড়কের খালে,
ডুবে ডুবে মাছ ধরতাম ডুবের তালে তালে।
‘রাজা খাঁ-ফুলডুবী-ঘি উড়া’ মিলে,
‘লাংগল চুরা’য় ঘনিয়া ধরতাম কিসমতে দিলে।
মাঝেরচরা পূবেরচরায় কোমর পানি থাকে,
নাও ঠেলে ভেড়া ধরতাম বিলের বাঁকে বাঁকে।
‘হাবিজখালীর অচু টানা’ ইছা মারার ধুম,
এসব কথা মনে হলে ছেড়ে যায় ঘুম।
গাত টেনে পুটি ধরতাম হৈ হৈ রবে,
এক সাথে দশ-বারজন সুর করিতাম সবে।
মুলায়েমডুবী-দুমূখা-আঠালুর খাল,
চৈত্র মাসে ‘পল বাওয়া’ সঙ্গে থাকে জাল।
কইরপল-তরিকুচা-অচু আর শেওত,
খাইনজা সেচে মাছ ধরতাম আল্লাহর নিয়ামত।
খাইনজা সেচা টেপি ধরা ফালগুন চৈত্র মাসে,
চারিদিকে সবুজ ধান কৃষাণ ভাই হাসে।
টেংরার ঘা যেমন তেমন শিংগীর ঘা সার,
কোকড়ার জড় বাঁধিয়া দিলেও বিষ নামে না তার।
ভাদ্র, আশ্বিন ‘নাইয়া অচু’ সারা বিকাল চলে,
চাটা-বইছা-হাগাটালু-নাপিত বাদার তলে।
জৈষ্ঠ্য মাসে ঠেলা জালে ‘কই পুতরা’ ধরে,
‘চংগর পনা’ কত ধরলাম পনার খলই ভরে।
গাংগের ঘোলায় লোয়ারগাঁওর ঢালায় ভীড় ধরে মাছে,
ঘরে ঘরে খুঁজে দেখতাম কার পল আছে?
বিন্নাটেকী মাঝর গোপাট নয়া বাড়ীর তলে,
বিলের দিকে চেয়ে থাকতাম নৌকা পাব বলে।
কিশোর কালের অবুঝ মন পল নিয়ে হাতে,
এক দৌড়ে বিলে পৌঁছতাম গায়ের মানুষ সাথে।
এলেংগারকান্দি পাতলাচুরা-গউয়াবিলের কাড়া,
সব মিলিয়ে উত্তর দিক গউয়ার পার সারা।
জামাইকাটার উত্তর দিক বিল গউয়ার পার,
এই জমিনে পড়ে আছে বাল্য জীবন আমার।
হরে খাওরা-বাজারকান্দি-নাপ্তর টেকার জমি,
বড়বন্দের ঘাসের মাঝে ধান ছিল না কমি।
ছাটিরলামা -হাদারদাগ -আঠালুরমুখ,
কত মাছের উজাই দেখলাম ভাবতে লাগে দুখ।
আতনাকান্দির হিজল গাছ কতই মনে পড়ে,
কত রংগের দিন কাটাইলাম গাছের ডাল চড়ে।
‘গুটির গরু’ নিয়ে মোরা বসতাম গাছের তলে,
পানির পিয়াস মিঠাইতাম আঠালুখালের জলে।
আতনাকান্দির গরু চরে কত গরু চরে,
রাখাল ছেলের মিষ্টি গানে মন থাকত ভরে।
দুপুর পরে গরু যায় বানাইয়ার পতিত,
বাজারকান্দির কিরা -বাংগি চুরি করতাম নীত।
বানাইয়ার দুর্বা ঘাসে কত গড়াগড়ি,
মাঝে মধ্যে ঘুমিয়ে পড়তাম বাঁশের ছাতা ধরি।
শত শত শনির লেটা মাথার উপর থাকে,
লুকুচুরি কত খেলতাম কোকড়া বনের ফাঁকে।
চাতলার পার আত্মাকান্দি বানাইয়ার পতিত,
আজও ইহা পড়ে আছে শুধু আমি অতীত।
বিকালেতে ‘বিন্নাটেকী’ মানুষ-গরুর মেলা,
ফুটবল আর তাস খেলাতে চলে সারা বেলা।
কিশোর কালের এসব কথা কত স্মৃতি জাগে,
বয়স কালে এইগুলি সব স্বপ্ন জগত লাগে।
কত সুন্দর হাওর আমার কত বড় আকার,
পুর্ব থেকে চেয়ে দেখলে পশ্চিম নিরাকার।
পূর্ব দিকে লহরী আর চরচন্ডীর পার,
পশ্চিমে লোহারগাঁও -রসুলগঞ্জ বাজার।
দক্ষিণে হাছল-আমড়াতৈল-নাছিরপুর মৌজা,
এই স্থানে রত্না নদী পূর্ব পশ্চিম সোজা।
উত্তরে জাহিদপুর আর তালুপাট ধরে,
এই জায়গায় ডাউকী নদী সারা গেছে মরে।
মাছুখালী চরচন্ডী আর কয়বরখালীর ডর,
উত্তরেতে চাউলধনী এই গুলার পর।
জামাইকাটা কত সুন্দর কত রূপের বাহার,
বর্ষাকালে ফুটে উঠে, পূর্নযৌবন তার।
কদম্বের ফুল ডাকি বর্ষারে কয়,
অপেক্ষায় ফুটে আছি, আসিবে নিশ্চয়।
বর্ষাকালে জামাইকাটায় পানি থৈ থৈ করে,
পাল উড়াইয়া কত নৌকা রসুলগঞ্জ ধরে।
সারি সারি পালের নৌকা জামাইকাটার বুকে,
শত শত ডিংগী -বারকী খালের মুখে মুখে।
জলের উপর ভাসছে গ্রাম ডুবু ডুবু ঘর,
শাপলা-শেওলার লুকুচুরি মন ভরে দেয় মোর।
জলে ভাসা পদ্মফুল জলে খেলা করে,
ও পারের ঢেউ আসি এ পারেতে পড়ে।
যুগনী খালের পশ্চিম পার নজীপুরের উত্তর,
চিনে রাখ এই জায়গা কদমতলীর চর।
সাদুল্লারটেক-বিন্নারটেক-আধুয়াচকের দাগ,
পাটুমোহা মৌজাসহ একলা বুড়ার ভাগ।
দেওয়ানখালী- কউব্লাটেকার পশ্চিম পাশ দিয়া,
উত্তরপারে যাইতাম আম্রা গুটির গরু নিয়া।
দেওয়ানখালীর পাড়াগাতি-গোবরাগাতি বড় ভয়ংকর,
অসাবধানে ‘পাও’ ঢুকিলে কষ্ট পাইতাম জবর।
পূবরলোম-হাদারদাগ রাতা টেপি শাইল,
মাঝখানে চলার রাস্তা নাম তার ‘বড়াইল’।
জামাইকাটায় আরো আছে ‘তেরাচাপড়ি বিল’,
খতমাপুর গেলে দেখবায় পানির ঝিলমিল।
সমসপুরের গরুর গোপাট আর নাও দাড়া দিয়া,
চান্দরখালে নৌকা যাইত দেখতাম চাইয়া চাইয়া।
চোরাইকান্দি-নোয়াগাঁও-ডিগ্রীকিত্তার পরে,
বেগুন-বাংগি বেশী ফলে গড়গড়ির চরে।
এতকথা বলবো কাকে, শুনার মানুষ নাই,
যাহা আছে দুই একজন, কদাচিৎ পাই।
মনযোগে শুন বলি পরবর্তি বংশ,
ভুলে গেলে পড়ে নিও ইতিহাসের অংশ।
পাঠকের কাছে আমার এই নিবেদন,
ভুল ত্রুটি কিছু হইলে করিবেন মার্জন।
লেখক : মিশিগান, যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী।
(কবিতাটি লেখকের নিজ এলাকা সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর উপজেলার আমড়াতৈল-এ তাঁর বাল্যকালের
স্মৃতিকে কেন্দ্র করে লেখা।)
No comments:
Post a Comment
bazlurusa@gmail.com